প্রশ্ন:- জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডে প্রেক্ষাপট এবং এর গুরুত্ব আলোচনা কর।
উত্তরঃ
সূচনা:-
রাওলাট আইনের প্রতিবাদে গান্ধীজীর আহবানে সাড়া দিয়ে সমগ্র দেশ জুড়ে শুরু হয় সত্যাগ্রহ আন্দোলন। 1919 খ্রিস্টাব্দে 13 ই এপ্রিল পাঞ্জাবের অমৃতসর শহরে জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক উদ্যানে এক শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশে জেনারেল ও' ডায়ারের নির্দেশে ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী গুলি চালালে সরকারি মতে 379 জন নিহত ও 1200 জন আহত হন। যদিও বেসরকারি মতে এই সংখ্যাটা অনেক বেশি। বর্বর ব্রিটিশ পুলিশের এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত।
প্রেক্ষাপট:- এই জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট নিম্নে আলোচনা করা হল।
1. ব্রিটিশ সরকারের তীব্র অত্যাচার:-
অত্যাচারী বৃটিশ সরকারের বিভিন্ন দমনমূলক পদক্ষেপ এর বিরুদ্ধে পাঞ্জাবে ব্রিটিশ বিরোধী গণআন্দোলন ক্রমশ তীব্র হতে থাকে। পাঞ্জাবির মুখ্য প্রশাসক লেফটেন্যান্ট গভর্নর মাইকেল এর অত্যাচারী শাসন পাঞ্জাবকে বারুদের স্তূপে পরিণত করে জুলুম চালিয়ে যুদ্ধের জন্য পাঞ্জাব থেকে সেনা ও অর্থ সংগ্রহ এবং বিদ্রোহ বিপ্লব প্রতিরোধ করতে পাঞ্জাবীদের ওপর চরম নির্যাতন চালানো বঞ্চনার প্রতিবাদ সমাবেশ ঘটনা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে মানুষকে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ করে তোলে।
2. কুখ্যাত রাওলাট আইন প্রণয়ন:-
সরকার ভারতীয় যাবতীয় স্বাধীনতার অধিকার কেড়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে কূখ্যাত নিষ্ঠুর দমনমূলক 1919 খ্রিস্টাব্দে রাওলাট আইন প্রবর্তন করলে দেশবাসী ক্ষুব্দ হয়ে ওঠে। এবং এই বিক্ষোভের আঁচ পাঞ্জাবে সবথেকে গভীর এবং অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
3. বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তার:-
এই সময় সরকার 1919 খ্রিস্টাব্দে 10 এপ্রিল অমৃতসরের স্থানীয় দুই নেতা সইফুদ্দিন কি ছিল ও সত্য পাল কে হিংসায় মদত দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করলে জনতা উত্তেজিত হয়ে ওঠে অন্যদিকে গান্ধীজিকে গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়লে লাহোরে স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট পালিত হয় মারমুখী জনতা বিভিন্ন সরকারি অফিস-আদালত টেলিগ্রাফ লাইন ইউরোপীয় নারী-পুরুষের ওপর আক্রমণ চালায়।
4. সামরিক শাসন জারি:-
অমৃতসরে আন্দোলন প্রবল হয়ে উঠলে জেনারেল মাইকেল ও' ডায়ারের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনীর হাতে পাঞ্জাবের শাসনভার তুলে দেওয়া হয় সামরিক আইন জারি করে 11 ই এপ্রিল শহরে জনসভা ও সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।
হত্যাকান্ড:-
এই অবস্থায় 1919 খ্রিস্টাব্দে 13 এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক উদ্যানে প্রায় 10 হাজার জনতা সমবেত হয়েছিল দুই জনপ্রিয় নেতা সইফুদ্দিন কিচলু ও ডক্টর সত্যপালের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। সভাস্থলটি চারদিকে ছিল বড় পাকা বাড়ি এবং প্রাচীর দিয়ে বেষ্টিত একটি উদ্যান এই উদ্যানে প্রবেশের জন্য ছিল একটি পথ এবং প্রস্থানের জন্য ছিল চারটি সংকীর্ণ গলিপথ। এই নির্দিষ্ট স্থানে বৈশাখী মেলা উপলক্ষে উপস্থিত হওয়ার নারী-পুরুষ ও শিশুদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যারা 11april ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক পাঞ্জাবে সামরিক শাসন জারি ও জনসভা ও সমাবেশ নিষিদ্ধের কথা জানত না।
পাঞ্জাবি সামরিক শাসন কর্তা মাইকেল ও' ডায়ারবিশাল সেনাবাহিনী সেখানে উপস্থিত হন এবং মাঠের ওই প্রবেশ পথ আটকে 50 টি রাইফেল থেকে জনগণকে কোন প্রকার সতর্কবার্তা না দিয়ে সেনাবাহিনীকে নির্বিচারে গুলি করার নির্দেশ দেন। সেনাবাহিনী 10 মিনিট ধরে প্রায় 16 রাউন্ড গুলি চালায়। প্রচুর মানুষ হতাহত হয় সরকারি হিসাব অনুসারে নিহতের সংখ্যা ছিল 379 জন এবং আহতের সংখ্যা ছিল 12 জন। কিন্তু বেসরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা 1 হাজার ছাড়িয়ে যায়। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য সরকারের তরফ থেকে কোনো ক্ষমা স্বীকার করা হয়নি শুধু তাই নয় ওই দিন অমৃতসরের সান্ধ্য আইন জারি করে মৃতদেহগুলোকে তাদের আত্মীয়দের হাতে তুলে দেওয়া কিংবা আহতদের সেবা শুশ্রূষা করার কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি।
প্রতিক্রিয়া:-
এই ভয়ানক ও মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের ঘটনায় ব্রিটিশ শাসনের প্রকৃত নগ্ন রূপটি প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং সারা দেশে বিদেশে সর্বত্রই এই নগ্ন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
1.এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইংরেজদের দেওয়ার 'নাইট' উপাধি ঘৃণাভরে ত্যাগ করেন এবং বলেন "পাঞ্জাবের দুঃখের তাপ আমার বুকের পাঁজর পুড়িয়ে দিলে।"
2. রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন "জালিয়ানওয়ালাবাগ সমগ্র ভারতে এক মহাযুদ্ধের আগুন জ্বেলে দেয়।"
3. মহাত্মা গান্ধী বলেন "এই শয়তান সরকারকে আর সংশোধন করা যাবে না একে শেষ করতেই হবে।"
4. জাতীয় কংগ্রেস একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে জেনারেল ডায়ার কে শাস্তি দানের সুপারিশ করে।
5. ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল বলেন "জালিয়ানওয়ালাবাগের মত মর্মান্তিক ঘটনা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে আর কখনো ঘটেছে বলে আমার মনে হয় না।"
6. এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সমগ্র দেশের মানুষ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভে ফেটে পড়েন।
7. এই হত্যাকাণ্ড ভারতবাসীকে এক তীব্র ইংরেজিতে পরিণত করেছিলো যার প্রভাব দেখা দিয়েছিল অসহযোগ আন্দোলনে।
8. অবশ্য এত প্রতিবাদ ও সমালোচনা সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের কথায় কোন প্রকার কর্ণপাত করেনি।
মূল্যায়ন:-
পরিশেষে বলা যায় ব্রিটিশ সরকার কর্ণপাত না করলেও শেষ পর্যন্ত উধম সিং নামে এক ভারতীয় 1941 খ্রিস্টাব্দে জেনারেল ও ডায়ারকে হত্যা করে জালিয়ান ওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ নিয়েছিলেন।


Super bro.,
ReplyDelete